শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ১০:০৩ পূর্বাহ্ন

এত সহজেই মেলে ড্রাইভিং লাইসেন্স!

এত সহজেই মেলে ড্রাইভিং লাইসেন্স!

স্বদেশ ডেস্ক: গাড়ি চালাতে না জানলেও মেলে ড্রাইভিং লাইসেন্স। কারণ সঠিক পদ্ধতিতে পরীক্ষা ছাড়াই পরীক্ষা বোর্ডে পাস করার সুযোগ থাকে। তবে এ জন্য গুনতে হয় বাড়তি অর্থ। আবার গাড়ি চালাতে জানলেও পরীক্ষায় বারবার ফেল করানোর সুযোগ আছে। এর সবই সম্ভব হচ্ছে ড্রাইভিং লাইসেন্সের বিদ্যমান পদ্ধতির ত্রুটিতে।

গাড়ি চালনার লার্নার (আবেদন) থেকে শুরু করে পরীক্ষা, পরীক্ষক ও ইনস্ট্রাক্টর সেন্টার, পরীক্ষার বোর্ড, লাইসেন্স সরবরাহের ব্যবস্থাপনা প্রত্যেকটির সিস্টেমের গোড়ায় গলদ রয়েছে। বিদ্যমান আইন মানতে গেলে বাস্তবতা মেলে না। তাই আর বাস্তবতা মানতে গিয়ে চলছে অনিয়ম-দুর্র্নীতি। আগে ভুয়া লাইসেন্স সংগ্রহ করার প্রবণতা ছিল।

এ জন্য ভুয়া কার্ড ছাপানোর সিন্ডিকেট ছিল সক্রিয়। এখন সিন্ডিকেট আছে তবে ভুয়া নয় বিআরটিএ স্বীকৃত। সত্যিকারের ড্রাইভিং লাইসেন্স সরবরাহ করছে তারা। এ কাজটি করতে খরচ পড়ছে লাইসেন্সপ্রতি ৮-১০ হাজার টাকা। এতেও সুবিধা চালকদের। হয়রানি ছাড়া লাইসেন্স পাচ্ছেন তারা। সেটি সম্ভব হচ্ছে পদ্ধতিগত ত্রুটির জেরে।

আবেদনের সময় পরীক্ষকের ভুয়া নাম ঠিকানা দিয়ে অনিয়মের শুরু। সময় বাঁচাতে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য পরীক্ষা বোর্ডে হাজির হলেও গাড়ি চালাতে হয় না। বড়জোর বিআরটিএ অফিসে রাখা গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে বসলেই পাস। এমনকি অনেক সময় ব্যবহারিক পরীক্ষার জন্য এ গাড়িতে না বসেও পার পাওয়া যায়। কেবল লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার খাতায় সই করেও পরীক্ষায় পাসের নজির আছে। এটি একমাত্র এ দেশে সম্ভব হচ্ছে কেবল পদ্ধতিগত ত্রুটিতে।

কারণ পরীক্ষা বোর্ডে স্বীকৃত সদস্যরা সবসময় উপস্থিত হতে পারেন না। আবার উপস্থিত হলেও তাদের যাতায়াত ও সম্মানী ভাতার ব্যাপারে মোটরযান আইনে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু উল্লেখ নেই। সে ক্ষেত্রে পরীক্ষা বোর্ড সদস্যরা সময়ের অভাবে যেতে না পারলে বিআরটিএর কর্মকর্তার মাধ্যমে পরবর্তীতে স্বাক্ষর নেওয়ার ঘটনাও ঘটে। আবার ড্রাইভিং বোর্ডে প্রতিনিধিরা উপস্থিত হলেও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা মোটরযানের পরিদর্শকের ‘নেতৃত্ব’ অস্বস্তির কারণ। তাই হাজিরা দেওয়াটাই দায়িত্ব সারা মনে হয়। যদিও সবসময় এমনটি ঘটে তা নয়।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী দেশে ৩৯ লাখ গাড়ির বিপরীতে অন্তত ৯ লাখ দক্ষ চালকের অভাব রয়েছে। সেই সঙ্গে ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা পদ্ধতিতেও রয়েছে গলদ। এ কারণে পরীক্ষা গ্রহণ ও লাইসেন্স সরবরাহ থেকে শুরু করে এ কার্যক্রমের সর্বত্র অনিয়মের সুযোগ রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে আইনের সঙ্গে বাস্তবতার মিল কম। এমন পরিস্থিতিতে ড্রাইভিং লাইসেন্সপ্রাপ্তির পরীক্ষা গ্রহণ পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে পরীক্ষা গ্রহণে ডুয়েল কন্ট্রোল সিস্টেম গাড়ি কেনা এবং পরীক্ষার বোর্ড পুনর্গঠনের কথা ভাবছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। তা ছাড়া বিদেশে কীভাবে পরীক্ষা নেওয়া হয়, তা দেখতে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে কমিটি গঠনেরও সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত হালকা যানের লাইসেন্সধারীদের তিন বছর পর মাঝারি মানের লাইসেন্স পেতে হয় পরীক্ষায় অংশ নিয়ে। আরও তিন বছর পর একইভাবে ভারী যান চালনার সুযোগ থাকে। কিন্তু দেশে ভারী যানবাহন চালকের সংকটের কারণে গত বছর এই শর্ত শিথিল করা হয়। বলা হয়, হালকা যান চালনার লাইসেন্সধারীরা এক বছর পর মাঝারি মানের ভারী গাড়ির লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারবেন। গত বছর ডিসেম্বরের পর এই শর্তের মেয়াদ চলতি জুন মাস পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। এখন আরও ৬ মাস মানে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত সুযোগ বাড়ানো হয়েছে।

এদিকে ড্রাইভিং লাইসেন্স পরিসংখ্যানের তুলনায় গাড়ি চালকের সংখ্যা বাস্তবে আরও কম বলে দাবি করেছেন সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। বর্তমান এমপি শাজাহান খান সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি। সড়ক পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা জোরদার এবং দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সুপারিশ দিতে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সর্বশেষ সভায় একটি কমিটি গঠন করা হয়। শাজাহান খানের নেতৃত্বে গঠিত ওই কমিটির ১১১টি সুপারিশসহ প্রতিবেদন সম্প্রতি জমা পড়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে।

এর পর এ নিয়ে গত রবিবার সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত আসে। প্রতিবেদনের ১০২ নম্বর সুপারিশে বলা হয়েছে, ড্রাইভিং কমপিটেন্সি টেস্ট বোর্ডের (ডিসিটিবি) কার্যক্রম আরও গতিশীল ও সময়োপযোগী করতে ভারত, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া, নেপাল, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশের পদ্ধতি অনুসরণ করা প্রয়োজন। এ জন্য সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বয়ে একটি টিম গঠন করে এসব দেশের পরীক্ষা গ্রহণ পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করে প্রস্তাব তৈরি করতে বলা হয়েছে। এর পর বিআরটিএর মাধ্যমে তা জমা দিতে হবে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে।

জানা গেছে, বর্তমানে ডিসিটিবির মাধ্যমে ড্রাইভিং পরীক্ষা নেওয়া হয়। কিন্তু এতে বোর্ডের নির্ধারিত সদস্যরা (অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, ইনস্ট্রাক্টর, সার্জন) নিজেরা সব সময় উপস্থিত থাকতে পারেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের প্রতিনিধি পাঠানো হয়। ফলে বিআরটিএর মোটরযান পরিদর্শকের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় প্রায়ই অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এ ছাড়া ড্রাইভিং টেস্ট বোর্ডের স্বল্পতাসহ একাধিক কারণে একজন আবেদনকারীকে পরীক্ষার জন্য এক থেকে দেড় বছর অপেক্ষা করতে হয়। অথচ তিন মাসের মধ্যে পরীক্ষা নিতে বলা হয়েছে মোটরযান আইনে।

আইনে আরও বলা আছে, পরীক্ষার্থীকে নিজে গাড়ি নিয়ে আসতে হবে পরীক্ষার বোর্ডে। কিন্তু সবার নিজস্ব গাড়ি থাকা স্বাভাবিক নয়। গাড়ি থাকলেও তা রাখার জায়গা নেই বিআরটিএর পরীক্ষা বোর্ড এলাকায়। তাই মধ্যস্বত্বভোগীরা গাড়ি সরবরাহ করে, চলে বাণিজ্য। এ সুযোগে গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট। দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগীর সহায়তায় পরীক্ষা বোর্ড ম্যানেজ করার অভিযোগ আছে। এতে করে সঠিকভাবে গাড়ি চালাতে না পারলেও লাইসেন্স মেলে।

বর্তমানে বিআরটিএর মেট্রো ও জেলা পর্যায়ে ৬৮টি ড্রাইভিং বোর্ডের মাধ্যমে গাড়ি চালনার যোগ্যতা যাচাই পরীক্ষা (লিখিত, মৌখিক ও ব্যবহারিক) নেওয়া হয়। প্রতিটি বোর্ডে মেট্রো সার্কেল অফিসে গড়ে ৪৫০ জন এবং জেলা পর্যায়ের অফিসে ১৫০ জনের পরীক্ষা নেওয়া হয়। তাই নিজস্ব তত্ত্বাবধানে গাড়ি কিনতে প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু করেছে বিআরটিএ। তবে গাড়িগুলো হবে ডুয়েল কন্ট্রোল সিস্টেমের। সঙ্গে সিসিটিভি ক্যামেরা, জিপিএস ট্র্যাকার থেকে শুরু করে আধুনিক যন্ত্রপাতিও যুক্ত থাকার শর্ত রয়েছে।

এতে গাড়িগুলো কেবল পরীক্ষা গ্রহণের পরিবর্তে অপব্যবহারের সুযোগ কম থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রতিটি অফিসের পরীক্ষার জন্য উপযুক্ত মোটরসাইকেল, থ্রি-হুইলার, হালকা মানের প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাস, মাঝারি মানের মিনিবাস ও মিনি ট্রাক এবং ভারী মানের বাস ও ট্রাক কেনারও প্রস্তাব করা হয়েছে। বিআরটিএর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এসব গাড়ি ব্যবহারে আবেদনকারীর কাছ থেকে ২০০ টাকা ফি ধার্য করা হতে পারে। পরীক্ষার্থীদের যারা ড্রাইভিং টেস্টে গাড়ি নিতে পারবেন না, তাদের কাছ থেকে এ ফি নেওয়ার চিন্তা করা হয়েছে। এতে মাসে প্রায় ৪ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, এ অর্থের একটি অংশ দিয়ে গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা হয়েছে-দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ডে ট্রান্সপোর্ট অথরিটি নিজস্ব গাড়ি দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরীক্ষা গ্রহণ করে থাকে।

গাড়ি কেনার পরিবর্তে আউটসোর্সিংয়ের প্রসঙ্গে বিআরটিএ কর্মকর্তারা জানান, শুধু একটি গাড়ি সরকারিভাবে আউটসোর্সিং করতে গেলে মাসে খরচ পড়বে প্রায় ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। তা ছাড়া এতে অসাধু ব্যবসার আশঙ্কা আছে। বিআরটিএ চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ড্রাইভিং পরীক্ষা ও লাইসেন্স প্রদান পদ্ধতি সহজ করতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে দেশে ভারী যানবাহনের মধ্যে বাস, কার্গো ভ্যান, কাভার্ডভ্যান, বিশেষ কাজে ব্যবহৃত গাড়ি, ট্যাংকার ও ট্রাক রয়েছে ২ লাখ ৫২ হাজার ১৬টি। এর বিপরীতে চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স রয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩২০টি। হালকা মানের হিউম্যান হলার, ট্যাক্সিক্যাব, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, জিপ ও পিকআপ, অ্যাম্বুলেন্স মিলে লাইসেন্স রয়েছে ৭ লাখ ১ হাজার ৭৯৪টি। অর্থাৎ লাইসেন্সধারী চালক বেশি থাকলেও বাস্তবতা হচ্ছে অনেকের লাইসেন্স আছে কিন্তু গাড়ি নেই।

এ ছাড়া দেশে মধ্যম মানের ডেলিভারি ভ্যান ও মিনিবাস আছে ৫৮ হাজার ২৭৯টি। বিপরীতে চালকের সংখ্যা ২৭ হাজার ২২১। এ ছাড়া ২৫ লাখ ৫৩ হাজার ৫০৯টি থ্রি-হুইলার, টেম্পো, মোটরসাইকেলের বিপরীতে চালক আছেন ১০ লাখ ৫৩ হাজার ৫৪১ জন। অর্থাৎ সব মিলে দেশে ৩৯ লাখ ২৭ হাজার ৭০২টি গাড়ি আছে। তার মানে ঘাটতি ৯ লাখ ৬ হাজার ৫৯০ জন চালকের।

শাজাহান খানের মতে, বিআরটিএর পরিসংখ্যানের তুলনায় বাস্তবে ভারী যানবাহনের লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা কম, প্রায় এক লাখ। অনেক চালক বিদেশে, কেউ কেউ মারা গেছেন। ফলে তাদের বাদ দিয়ে সঠিক পরিসংখ্যান দরকার। আর চালক স্বল্পতা নিরসনে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে, তা-ও পর্যাপ্ত নয়। দক্ষ চালক তৈরিতে প্রশিক্ষকের অভাব আছে। তাই ভুয়া লাইসেন্সধারীকে ধরে জেলে না দিয়ে ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে তাকে লাইসেন্স দেওয়ার অভিমত প্রকাশ করেছেন তিনি।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877